কোরআন ও হাদিসের আলোকে কোরবানী (sacrifice in Islam)

কোরবানি (sacrifice) ইসলামের মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।  আদম (আ.) থেকে শুরু করে সব নবীর যুগেই কোরবানি পালিত হয়েছে।
কোরবানির মাধ্যমে গরিব-দুঃখী ও প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়। আল্লাহ ও তার রাসূলের শর্তহীন আনুগত্য, ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষাও আছে কোরবানিতে। নবীজিকে আল্লাহতাআলা নির্দেশ দিয়েছেন- আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।  (সুরা কাওসার:২) 
অন্য আয়াতে এসেছে- (হে রাসূল!) আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ রাব্বুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত। (সুরা আনআম : ১৬২) 

তাই কোরবানি (sacrifice) আদায়ের সকল বিধানও আমরা পেয়ে যাই কোরআন ও হাদিসের বর্ণনায়। আসন্ন কোরবানির জরুরি কিছু বিধান পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করা হলো- 
কোরবানি কাদের উপর ওয়াজিব
প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী ওপর ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের ভেতরে কোরবানি করা ওয়াজিব।
অর্থ-কড়ি, টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, গহনা-অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির অতিরিক্ত জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
এক. কোরবানির পশু কেমন হবে? 
• হাদিসের আলোকে কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হৃষ্টপুষ্ট, নিখুঁত ও উত্তম পশু কোরবানি করতেন এবং খুঁতবিশিষ্ট পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন। 
খুঁতবিশিষ্ট যে সব প্রাণিতে কোরবানি বৈধ নয়- সুন্নাহর আলোকে ইসলামী স্কলারগণ তা নির্ধারণ করেছেন। 
যে সব পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে না এমন খোঁড়া পশুর কোরবানি জায়েজ নয়।
পশু রুগ্ন এমন দূর্বল যে জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়।
যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না- এমন পশু দ্বারাও কোরবানি করা জায়েজ নয়।
যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুও কোরবানি জায়েজ নয়।  যে পশুর অর্ধেক শিং বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি সে পশু কোরবানি করা জায়েজ আছে।
যে পশুর লেজ বা কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে তাহলে তার কোরবানি জায়েজ আছে। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই।
যে পশুর এক চোখ পুরো নষ্ট বা দুটি চোখই অন্ধ সে পশু কোরবানি করা জায়েজ নয়।
গর্ভবতী পশু কোরবানি করা জায়েজ। জবাইয়ের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে। তবে প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কোরবানি করা মাকরূহ।
কোরবানির নিয়তে ভালো পশু কেনার পর যদি এমন কোনো দোষ দেখা দেয় যে কারণে কোরবানি জায়েজ হয় না- তাহলে ঐ পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। এর স্থলে আরেকটি পশু কোরবানি করতে হবে।
নিশ্চিত জানা না থাকলে বিক্রেতা যদি কোরবানির পশুর বয়স পূর্ণ হয়েছে বলে স্বীকার করে এবং পশুর শরীরের অবস্থা দেখেও তাই মনে হয় তাহলে বিক্রেতার কথার ওপর নির্ভর করে পশু কেনা এবং তা দ্বারা কোরবানি করা যাবে।
দুই. ঈদের তিন দিনে কোরবানি কখন করবেন?
মুসলিম উম্মাহর সার্বজনীন দুইটি উৎসবের অন্যতম একটি কোরবানির ঈদ। ঈদুল আজহার প্রধান আকর্ষণ পশু কোরবানি করা। নিজের অর্থে কেনা পশুটি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে জবাই করার মাধ্যমে একজন প্রকৃত মুসলমান মূলত নিজেকে আল্লাহর কাছে সমপর্ণের শিক্ষা নেয়
যাদের ওপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা জায়েজ নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামাজ না হয় তাহলে ঈদের নামাজ আদায় পরিমাণ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ঐ দিন কোরবানি করা জায়েজ।
মোট তিন দিন কোরবানি করা যায়। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে জিলহজের ১০ তারিখেই কোরবানি করা উত্তম। (মুয়াত্তা মালেক : ১৮৮, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯৮, ২৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/২৯৫)
যেসব এলাকার লোকদের ওপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব, তাদের জন্য ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা জায়েজ নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামাজ না হয়, তাহলে ঈদের নামাজের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কোরবানি করা জায়েজ। (বুখারি : ২/৮৩২, ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩১৮)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- 'যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পূর্বে কোরবানির পশু জবাই করবে সেটা তার নিজের জন্য সাধারণ জবাই হবে। আর যে নামাজ ও খুতবার পর জবাই করবে তার কোরবানি পূর্ণ হবে এবং সে-ই মুসলমানদের রীতি অনুসরণ করেছে।'
কেউ যদি কোরবানির দিনগুলোতে ওয়াজিব কোরবানি দিতে না পারে। কোরবানির পশু ক্রয় না করলে তার ওপর কোরবানির উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। 
আর যদি পশু ক্রয় করে থাকে, কিন্তু কোনো কারণে কোরবানি দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করতে হবে।
তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পাবে তা-ও সদকা করতে হবে।
তিন. কোরবানির প্রাসঙ্গিক কিছু বিধান
আকিকা আলাদা আদায় করা সুন্নত হলেও কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে শরিক হতে পারবে। এতে কোরবানি ও আকিকা দুটোই সহীহ হবে।
• মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি করা জায়েজ। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে। কোরবানির স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। 
• মৃত ব্যক্তি যদি কোরবানির ওসিয়ত করে থাকে তবে এই গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরিব-মিসকিনদের মাধ্যে সদকা করে দিতে হবে।
• কোরবানির গোশত, হাড়, চর্বি, চামড়া ইত্যাদি বিক্রি করা কোরবানিদাতার জন্য জায়েজ নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে।
• কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েজ নয়। গোশতও পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরও গোশত খাওয়ানো যাবে।কোরবানির পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেয়া-নেয়া জায়েজ। তবে কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দান এবং গ্রহণ কোনটাই করা যাবে না।উপরোক্ত বিধানের আলোকে আমরা আসন্ন কোরবানির পশু ক্রয় ও জবাই করি।  পাশাপাশি  আল্লাহর জন্য নিজের সকল অবৈধ চাহিদা ও পশুত্বকেও কোরবানি করি।
কোনো অংশীদারের নিয়ত গলদ হলে 
• অংশীদারদের কেউ যদি আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কোরবানি না করে, শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করে; তাহলে তার কোরবানি শুদ্ধ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে অংশীদারদেরও কোরবানি হবে না। তাই অংশীদার নির্বাচনে সতর্ক হওয়া জরুরি। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯)
একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা কোরবানি শুধু একজনই দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে করলে কারো কোরবানি শুদ্ধ হবে না।
• উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারবে। সাতের অধিক শরিক হলে কারো কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (সহিহ মুসলিম : ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক : ১/৩১৯, কাজিখান : ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৭-২০৮)
• উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগেকোরবানি করা জায়েয। (মুসলিম, হাদিস: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)
• শৈশবে আকিকা করা না হলে বড় হওয়ার পরও আকিকা করা যাবে। যার আকিকা সে নিজে এবং তার মা-বাবাও আকীকারগোশত খেতে পারবে। (ইলাউস সুনান: ১৭/১২৬)
• ফাতাওয়া শামীসহ ফিকহ-ফাতাওয়ার কিতাবাদিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কোরবানির সাথে আকীকা সহীহ। (রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬; হাশিয়াতুত তহতাভি আলাদ্দুর: ৪/১১৬)
• কেউ যদি গরু, মহিষ বা উট একা কোরবানি দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয়, তাহলে তার জন্য এপশুতে অন্যকে অংশীদার করা জায়েয। তবে এতে কাউকে শরিক না করে একা কোরবানি করাই শ্রেয়। শরিক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম।
• আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরীব হয়, যার উপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়, তাহলে যেহেতু কোরবানির নিয়তে পশুটি ক্রয় করার মাধ্যমে লোকটি তার পুরোটাই আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে, তাই তার জন্য এপশুতে অন্যকে শরিক করা জায়েজ নয়। যদি শরিক করে তবে ওই টাকা সদকা করে দেওয়া জরুরি হবে। কোরবানির পশুতে কাউকে শরিক করতে চাইলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিতে হবে। (কাজিখান: ৩/৩৫০-৩৫১, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২১০)
• কোরবানির পশু আগে থেকে নির্ধারিত হোক বা কোরবানির দিনগুলোতে কেনা হোক—উভয় পদ্ধতি বৈধ। যদি কোরবানির নিয়তে পশু ক্রয়কারী নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হয়, তাহলে ক্রয়ের মাধ্যমে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়ে যায়।
কোরবানির পশুতে আকিকার অংশ
• কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে অংশীদার হতে পারবে। এতে কোরবানি ও আকিকা দুটোই  শুদ্ধ হবে। ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ দিতে হবে।
হারাম টাকার কোরবানি শুদ্ধ নয়
• কোরবানি করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকা দ্বারা কোরবানি করা শুদ্ধ নয় এবং এক্ষেত্রে অন্য অংশীদারদের কোরবানিও শুদ্ধ হবে না।
অংশীদার যদি ওলিমা ও আকিকা করতে চায়?
বড় পশুতে (যাতে শরিকে কোরবানি করা বৈধ) কোরবানি ও আকিকার নিয়তে অংশীদার হওয়া বৈধ। শর্ত হলো, শরিকরা কোরবানি বা আকিকার বাইরে অন্য কোনো নিয়ত করবে না। দ্বিতীয় শর্ত হলো, কারো অংশ এক-সপ্তমাংশের চেয়ে কম হবে না। একইভাবে কোনো অংশীদার যদি কোরবানির নিয়ত করে এবং কোনো অংশীদার যদি ওলিমার নিয়ত করে, তবে তাদের একত্রে কোরবানি করা বৈধ। (আজিজুল ফাতাওয়া : ১/৭১৮, ফাতাওয়ায়ে শামি : ৬/৩২৬)
জবাই করার পর অংশীদার হওয়া যাবে?
কোরবানির পশু জবাই হওয়ার পর তাতে অংশের কোনো পরিবর্তন বৈধ নয়। জবাইয়ের পর অংশীদার হওয়ার জন্য কেউ অর্থ দিলে তা ফেরত দেওয়া আবশ্যক। (আজিজুল ফাতাওয়া : ১/৭১৯)
শরিকানার অর্থে কমবেশি করায় কোরবানি হবে?
যদি একাধিক ব্যক্তি অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি করতে চায়, তাহলে তারা সমানভাবে পশুর মূল্য ও অন্যান্য খরচ পরিশোধ করবে। তবে যদি স্বেচ্ছায় কোনো অংশীদার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে, তাহলে তা অবৈধ নয়। (আজিজুল ফাতাওয়া : ১/৭২৪)
 
স্ত্রী ও সন্তানের পক্ষে স্বামী ও পিতার কোরবানি করার বিধান
যদি কোনো অঞ্চলের প্রচলন এমন হয় যে সেখানে স্বামী তাঁর স্ত্রীর পক্ষ থেকে এবং পিতা তাঁর বালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে কোরবানি করেন। আর স্ত্রী ও সন্তান এই প্রচলনের কথা সম্পর্কে অবগত থাকেন। তবে পিতা ও স্বামীর কোরবানি তাদের পক্ষে যথেষ্ট হবে। সন্তান ও স্ত্রীর স্পষ্ট অনুমতির প্রয়োজন হবে না। আর প্রচলন ব্যাপক না হলে সেখানে স্ত্রী ও সন্তানের ওয়াজিব কোরবানি আদায়ের জন্য স্পষ্ট অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। নফল কোরবানির জন্য অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই। (ফাতাওয়ায়ে শামি : ৫/২০৭)
কোরবানির পশু জবাই করে কি অর্থ নেওয়া যাবে?
অনেকের ধারণা, কোরবানির পশু জবাই করে অর্থ গ্রহণ করা যাবে না। এটা ভুল। কোরবানির পশু জবাই করে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ। এটি জবাইকারীর অধিকার। শর্ত হলো, কাজ ও পারিশ্রমিক উভয়টি নির্ধারন করতে হবে। কোনো ইমাম যদি পশু জবাই করে নিয়মিত অর্থ গ্রহণ করেন, তাঁর পেছনে নামাজ আদায়ে কোনো সমস্যা নেই। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/২৪৫)
নারীরা কি পশু জবাই করতে পারবে?
সমাজের একটি ভুল ধারণা হলো, নারীদের জবাই করার অবকাশ নেই। এটি ভুল। নারীরাও কোরবানির পশু জবাই করতে পারবে। এমনকি জারজ সন্তানও কোরবানির পশু জবাই করতে পারবে। নাবালেগ শিশুও কোরবানি করতে পারবে। শর্ত হলো, পশু কোরবানির নিয়ম সম্পর্কে অবগত হওয়া, ঠিকভাবে জবাই করা এবং বিসমিল্লাহ পাঠ করা। (এমদাদুল ফতোয়া : ৩/৫৪৮)
কোনো ব্যক্তি অবৈধ মনে করে নারীকে পশু জবাই করতে বাধা দিলে সে গুনাহগার হবে। (ইমদাদুল মুফতিন : ২/৯৫৭)
পশু জবাইয়ে অমুসলিমদের সহযোগিতা গ্রহণ করা যাবে?
পশু জবাইকারী যদি মুসলিম হয়, পশু যারা ধরেছে তারা অমুসলিম হলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ যারা পশু ধরে তাদের ওপর ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করা ওয়াজিব নয় এবং তাদের পাঠ করা বা না করায় জবাইয়ের কোনো ক্ষতিও হয় না। তবে কেউ জবাইয়ের কাজে অংশীদার হলে তার ওপর ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করা ওয়াজিব। যেমন—কেউ শক্তি জোগানোর জন্য যদি জবাইকারীর হাতের ওপর হাত রাখে, একজন জবাই করার পর অন্যজন আবারও ছুরি চালায়, তখন তার ওপর ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করা ওয়াজিব। শুধু পশু ধরার মাধ্যমে ব্যক্তিকে জবাইয়ের কাজে অংশীদার বলা যাবে না। (ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৩/৫৪৯)
জবাই শুদ্ধ হওয়ার শর্তসমূহ
কোরআন ও সুন্নাহর বিধান অনুযায়ী জবাই শুদ্ধ তথা জবাইকৃত পশুর গোশত বৈধ হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত পালন আবশ্যক। এক. জবাইকারী মুসলিম হবে। দুই. জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা। তিন. শরিয়তসম্মত পদ্ধতিতে পশু জবাই করা। তা হলো, পশুর খাদ্যনালি, দুটি শ্বাসনালি ও রক্তনালি কাটা।
জবাইয়ের সময় পশুকে কষ্ট দেওয়া বৈধ নয়
শাদ্দাদ বিন আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কাজে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন আবশ্যক করেছেন। সুতরাং যখন তোমরা হত্যা করবে সুন্দরভাবে হত্যা করবে। যখন তোমরা জবাই করবে, সুন্দরভাবে জবাই করবে। তোমাদের প্রত্যেকে যেন (পূর্ব থেকে) ছুরি ধার দিয়ে নেয় এবং প্রাণীকে শান্তি দেয় (দ্রুত কষ্টমুক্ত করে)।’ (বুখারি)
উল্লিখিত হাদিসের দাবি হলো, প্রাণী হত্যায় মানুষ সর্বোচ্চ সুপন্থা অনুসরণ করবে, যেন প্রাণীর অতিরিক্ত কষ্ট না হয়। জবাইয়ের সময় প্রাণীর কষ্ট শতভাগ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে ছুরি ধারালো হলে তার মৃত্যু সহজ হয়। তাই হাদিসে পশু জবাইয়ের আগে ছুরি ধারালো করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জবাইয়ের আগে প্রাণীকে পানি পান করানো এবং ছুরি ধারালো করা মুস্তাহাব। শাস্তি দেওয়ার অর্থ হলো, জবাইয়ের অনেক আগ থেকে বেঁধে না রাখা এবং জবাইয়ের পর প্রাণত্যাগের সময় দেওয়া। অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) জবাইয়ের আগে ছুরি প্রাণীর সামনে আনতে, তার সামনে ছুরি ধার দিতে নিষেধ করেছেন এবং দ্রুত জবাইয়ের কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
পশু হত্যার সময় তার সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা উচিত নয়। সম্ভব হলে একটি প্রাণীর সামনে অন্য প্রাণী জবাই দেওয়া থেকে বিরত থাকবে, যেন সে মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর ভয়ে ভীত না হয়। অনেক সময় মৃত্যুভয়ে প্রাণী ছোটাছুটি করে। তখন পশুর সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা অনুচিত। জবাইয়ের পর প্রাণীর প্রাণ বের হয়ে যাওয়ার পর তার চামড়া ছাড়াবে। প্রাণ বের হওয়ার আগে বা পশু পুরোপুরি শান্ত হওয়ার আগে চামড়া ছাড়ানো হারাম। তবে কেউ পশু পুরোপুরি শান্ত হওয়ার আগে চামড়া ছিললে গোশত হারাম হবে না, যদিও সে পশুকে কষ্ট দেওয়ার কারণে গুনাহগার হবে। চামড়া একসঙ্গে পুরোটা ছিলাও বৈধ আবার টুকরা টুকরা করে ছিলাও বৈধ। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/২৫৭, আগলাতুল আওয়াম, পৃষ্ঠা ১৩৪)
জবাইয়ের স্থানে পশুকে টেনেহিঁছড়ে নিয়ে যাওয়া, শোয়ানোর পর জবাই করতে দেরি করা, পশুর সামনে ছুরি ধারানো মাকরুহ। (ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি : ৪/৮১)
 
পশু জবাইয়ের সময় যেসব বিষয় লক্ষ রাখা প্রয়োজন
১.   জবাইয়ের আগে প্রাণীকে দানা-পানি খাওয়ানো মুস্তাহাব। পশুকে ক্ষুধার্ত রেখে জবাই দেওয়া মাকরুহ।
২.  নির্দয়ভাবে জবাইয়ের স্থানে নেবে না।
৩.  যতটা সম্ভব সহজে শোয়ানোর চেষ্টা করবে। অতিরিক্ত কষ্ট হয়—এমন পদ্ধতি পরিহার করবে।
৪.  কিবলামুখী ও বাঁ পাশে শোয়াবে, যেন সহজে প্রাণ নাশ হয়। বিপরীত করা মাকরুহ।
৫.  চার পায়ের তিন পা বাঁধবে।
৬. ছুরি ধারালো করবে। ভোঁতা ছুরি দিয়ে জবাই করা মাকরুহ।
৭.  পশুর সামনে ছুরি ধার দেবে না। এটি মাকরুহ।
৮.  শোয়ানোর পর জবাই করতে দেরি করা মাকরুহ।
৯.  এক পশুর সামনে অন্য পশু জবাই করা মাকরুহ।
১০. জবাইয়ের সময় মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা বা কাটতে কাটতে গলার হাড়ের সাদা মগজ পর্যন্ত চলে যাওয়া মাকরুহ।
১১. ঘাড়ের ওপরের দিক থেকে জবাই করা নিষিদ্ধ। কারণ এতে পশুর বেশি কষ্ট হয়।
১২. জবাইয়ের পর পশু পুরোপুরি স্থির হওয়ার আগে ঘাড় আলাদা করা এবং চামড়া ছাড়ানো মাকরুহ। উল্লিখিত বিষয়গুলো কোরবানির সঙ্গে বিশেষায়িত নয়, বরং যেকোনো সময় পশু কোরবানির ক্ষেত্রে তা বিবেচ্য। (ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া : ১/৯৮)
 
কোরবানির গোশত কি জমিয়ে রাখা যাবে ?
কোরবানির গোশত তিন দিনেরও অধিক জমিয়ে রেখে খাওয়া জায়েজ। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৪, মুসলিম ২/১৫৯, মুয়াত্তা মালেক : ১/৩১৮)
শরিকে কোরবানি করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নয়। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩১৭, কাজিখান : ৩/৩৫১)
কোরবানির গোশতের এক-তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয়, তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৪, আলমগিরি : ৫/৩০০)
মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে কি কোরবানি করা যাবে ?
সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকে কোরবানি করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.)-কে তাঁর পক্ষ থেকে কোরবানি করার অসিয়ত করেছিলেন। তাই তিনি প্রতিবছর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকেও কোরবানি দিতেন। (আবু দাউদ : ২/২৯, তিরমিজি : ১/২৭৫)
কাজের লোককে কোরবানির গোশত কি দেওয়া যাবে ?
কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ নয়। গোশতও পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্যান্য সদস্যের মতো কাজের লোকদেরও গোশত খাওয়ানো যাবে। (আহকামুল কোরআন জাসসাস : ৩/২৩৭, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৪)
কোরবানি থেকে কুপ্রবৃত্তির দমনের এই দৃঢ়সংকল্পও আমাদের গ্রহণ করা উচিত।আল্লাহতাআলাও এটাই চান, বলেছেনও তাই- (মনে রেখো, কোরবানির জন্তুর) গোশত অথবা রক্ত আল্লাহর কাছে কখনোই  পৌঁছে না; বরং তার কাছে কেবলমাত্র তোমাদের পরহেজগারিই পৌঁছে। (সূরা হজ: ৩৭) 
আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন
তথ্যসূত্রঃ হাদিসের গ্রন্থসমূহ- সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, সুনানে তিরমিযী, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে বাইহাকি, মাজমাউয যাওয়াইদ।ফতোয়ার গ্রন্থসমূহ— ইলাউস সুনান-খণ্ড ১৭, রদ্দুল মুহতার-খণ্ড ৪, দুররুল মুখতার-খণ্ড ৬, ফাতওয়ায়ে আলমগীরি-খণ্ড ৫, বাদায়েউস সানায়ে'-খণ্ড ৪, আল বাহরুর রায়েক-খণ্ড ৮, ফাতওয়ায়ে কাযিখান-খণ্ড ৩, কিফায়াতুল মুফতি-খণ্ড ৮,আহকামে ঈদুল আজহা।

Post a Comment

0 Comments