Internet Addictio

 ইন্টারনেটে আসক্তির ক্ষতি

বর্তমানে স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।  আজ এই ইন্টারনেট অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োজনের চাইতে  অতিরিক্ত সময় ইন্টারনেটে কাটানো, গেমস, পর্ন, অনলাইন শপিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পড়ে, থাকা ভিডিও দেখা ইত্যাদি কাজে ইন্টারনেটের জগতে সময়  কাটানোর মাধ্যমে এই আসক্তি তৈরি হয়। 

এই আসক্তির ফলে নিজের ব্যক্তিগত জীবন, কর্মক্ষেত্রসহ, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। 

  ইন্টারনেট ব্যবহারে আপনার অবস্থান নির্ণয় করুন  

ইন্টারনেট আসক্তির ফলে কী সমস্যা দেখা দিতে পারে?

কোন আসক্তিই জীবনে ভালো কোন ফল বয়ে আনে না। একইভাবে ইন্টারনেট আসক্তি থেকেও দেখা দেওয়া শুরু করবে নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো-

১. কাজের প্রতি অনিহাঃ

সময়ে অসময়ে ইন্টারনেটে প্রবেশ করা এবং ব্যক্তিগত কাজে অনাগ্রহ তৈরি।

২. কাজের সময়সূচীতে অনিয়মঃ

ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতীতের সময়সূচী এবং বর্তমান সময়সূচীতে যাদের বিস্তর ফারাক রয়েছে। অর্থাৎ পূর্বে কেবল নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয় অনুসন্ধান কিংবা ব্যক্তিগত ব্যবহারে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।  

৩. ইন্টারনেটকে অত্যাধিক গুরুত্ব প্রদানঃ

কোন ব্যক্তির কাছে যখন ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ইউটিউব, মেসেঞ্জারসহ ইন্টারনেটই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বের বিষয় তখন বুঝতে হবে, ইন্টারনেটে আসক্ত।

৪. অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহারঃ

কোন ব্যক্তির ইন্টারনেট ব্যবহারকে কেন্দ্র করে যখন তার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং পরিবারের অসংখ্য সমস্যা এর দ্বারা গঠিত, তখন সেই ইন্টারনেট ব্যবহার আসক্তির কারন হয়ে দাড়ায়।

৫. দৈনন্দিন কাজকে মূল্যায়ন না করাঃ

যখন কারো ইন্টারনেট ব্যবহার এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, তার কাছে ব্যক্তিগত কাজ, পড়াশোনা, অফিসের কাজ, ঘুম ও বিশ্রাম এমনকি ধর্মীয় ক্ষেত্রেও মূল্যবোধ কমে যায়, সে নিঃসন্দেহে আসক্ত।

৬. ইন্টারনেট ব্যবহার পরিত্যাগ করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়াঃ

এছাড়া কেউ যখন তার ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে স্বজনদের মিথ্যে বলে এবং বারবার ইন্টারনেট ব্যবহার করা কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে, তাহলে সে ইন্টারনেটে আসক্ত।

৭. স্ক্রিন আসক্তিঃ

যে ব্যক্তি অন্তত দৈনিক ১২০ থেকে ১৫০ বার তার স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে বা ইন্টারনেট আপডেট পাওয়ার আশায় কম্পিউটারের মনিটরে তাকায়, সে মারাত্মকভাবে আসক্তিতে ভোগছে।

৮. বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম যখন ইন্টারনেটঃ

যার কাছে ইন্টারনেটই একমাত্র আনন্দ কিংবা বিনোদনের জায়গা, এর বাইরে সবই অস্বস্তিকর সে-ই ইন্টারনেটে আসক্ত।

৯. স্বভাব চরিত্রের অবনতিঃ

ইন্টারনেটে আসক্ত ব্যক্তির মধ্যে চরিত্রগত, স্বভাবগত ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তণ লক্ষ্য করা যাবে এবং অনেক বদভ্যাসের লক্ষণ ফুটে ওঠবে। যেমন- শৃঙখলা ভঙ্গ, অনেক রাত জাগা, সারাদিন ঘুমানো বা সকালে দেড়ি করে ঘুম ভাঙ্গা, চোখ-মুখ অবসন্ন  লাগা ও চেহেরা ফ্যাকাশে দেখানো এবং অমার্জিত বা অশালীন ব্যবহার।

১০. রুচিগত পরিবর্তনঃ

রুচিগত কিংবা পছন্দের পরিবর্তন। অত্যাধিক ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে সে ব্যক্তির ফ্যাশন, স্টাইল ও বাক্য বিনিময়ের সময় নিজস্বতা কমে যাবে এবং সে সর্বক্ষণ যেসবের মধ্যে নিমজ্জিত থাকে সেসবের প্রভাব বহিঃপ্রকাশ হবে।

১১. অস্বাভাবিক যৌণ আকাঙ্ক্ষাঃ

ইন্টারনেটে আসক্ত ব্যক্তি সর্বদা ইন্টারনেটে পর্ণোসাইট ভিজিট করার ফলে নিজ সঙ্গীর সাথেও মাত্রাতিরিক্ত  যৌন চাহিদা মিটাতে চাইবে এবং বেপরোয়া আচরণ লক্ষ্য করা যাবে। স্বাভাবিক আচরণে পরিবর্তন দেখা যাবে।

১২. সাইবার বুলিয়িংঃ

বুলিয়িং বলতে বোঝায় অবমাননা করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। কোনো মানুষকে বাস্তবে বা সামনাসামনি অবমাননা ও খারাপ মন্তব্য করার চেয়ে ইন্টারনেট তথা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা অনেক সহজ। সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন তারকারা এ সাইবার বুলিয়িংয়ের সবচেয়ে বড় শিকার। অনলাইনে সাইবার বুলিয়িংয়ের শিকার একজন ব্যক্তি খারাপ মন্তব্য বা মতামতের কারণে অপমানিত-অপদস্থ বোধ করেন। সাইবার বুলিয়িংয়ের শিকারে আত্মহত্যা পর্যন্ত ঘটে থাকে।

 ১৩. শারীরিক অক্ষমতাঃ

ইন্টারনেটের অত্যন্ত বেশি আসক্তি শারীরিক অক্ষমতার কারণও। তাই যে মানুষ বেশি সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করে সে তুলনামূলকভাবে খেলাধুলা, ব্যায়ামের মতো শারীরিক কার্যক্রম কম করে থাকে। আর এভাবে ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষকে শারীরিক অক্ষমতার দিকে নিয়ে যায়। এর ফলে মানুষ শারীরিকভাবে এক সময় দুর্বল প্রাণীতে পরিণত হয়ে যাবে।

১৪. রাতে ঘুম না হওয়াঃ

রাত্রে ঘুম না হওয়া এক প্রকার রোগ, যাকে বলা হয় ইনসমনিয়া।

১৫. ঘাড়ের ব্যথাঃ

মাথা নিচু করে স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করার অভ্যাস এ সমস্যার অন্যতম কারণ। দীর্ঘদিন অনেক সময় ধরে মাথা নিচু করে স্মার্টফোন বা মোবাইল ব্যবহারের অভ্যাস চিরস্থায়ী ঘাড়ের সমস্যার জন্ম দিতে পারে। মাথা কাত করে, নিচু হয়ে, বাঁকা করে একদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার ফলে এটি মানুষের ঘাড়ের ওপর চাপের সৃষ্টি করে যা পরে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করে।

শারীরিক লক্ষণ

১. খাবারের প্রতি অনিহাঃ

ইন্টারনেট ব্যবহারে সর্বদা আধুনিকতার স্পর্শে থাকার ফলে খাদ্যাভ্যাসে ও চলন-বলনে পরিবর্তন দেখা গেলে বুঝা যাবে সে ইন্টারনেটে আসক্ত।

২. নেশাদ্রব্যের প্রতি আগ্রহ ও আসক্ত হওয়াঃ

ইন্টারনেটে দীর্ঘসময় পার করতে গিয়ে  নেশাজাতীয় দ্রব্যের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। কেননা যারা ঘন্টার পর ঘন্টা অনলাইনে সময় কাটায় সেসময়ে তাদের ক্লান্তি ও একঘেয়েমি কাটাতে প্রচুর সিগারেট ও মদ্যপান করার প্রবণতা তৈরি হয়। এভাবে প্রচন্ড রকমের ধূমপান বা অন্য নেশাদ্রব্যে আসক্ত হতে দেখলে বুঝতে হবে, নিশ্চয় এর পিছনে ইন্টারনেট আসক্তির কারণ থাকতে পারে। 

৩. যৌন চাহিদা হ্রাস পাওয়াঃ

কখনো কখনো যৌন ক্ষমতা ও যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যায় এবং সহধর্মীনিকে সময় না দিয়ে ইন্টারনেটে ব্লু-ফিল্ম কিংবা পর্ণো সাইটে আসক্ত হয়। ফলে যৌনাঙ্গের চরম ক্ষতি হওয়ার ফলে সে স্বাভাবিক যৌন জীবন এড়িয়ে চলতে থাকে। এরূপ লক্ষণ দেখলে বুঝতে হবে সে ইন্টারনেটে আসক্ত।

মানসিক লক্ষণ

১. মানসিক সমস্যাঃ

ইন্টারনেট থেকে বের হলেই যদি কারো বিষন্নতা, অস্থিরতা ও অপ্রসন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে বুঝা যাবে সে ব্যক্তি ইন্টারনেটে আসক্ত।

২. পারস্পরিক যোগাযোগে অনিহাঃ

পারিবারের সদস্যদের সাথে এবং বাহিরের মানুষের সাথে যোগাযোগ কমে যাবে এবং সবসময় ব্যস্ততা দেখানোর মাধ্যমে যেকোন বিষয় এড়িয়ে চলতে থাকলে বুঝা যাবে, তার সময় কাটানো কেন্দ্রীয় স্থান ইন্টারনেট।

৩. মিথ্যে বলার প্রবণতাঃ

ইন্টারনেটে আসক্ত ব্যক্তি প্রায়শই মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলবে এবং অনেক কিছু লুকানোর চেষ্টা করবে।

৪. ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনঃ

ইন্টারনেট আসক্তির ক্ষেত্রে খুব সাধারণ একটি লক্ষণ হলো ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন। ইন্টারনেটে আসক্ত ব্যক্তির মেজাজ যেকোন সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং যেকোন ব্যক্তির সাথে অসদাচারণ করতে পারে। এমনকি পরিবারের সাথে ভাঙ্গন এবং জীবন সঙ্গীকে ছেড়ে বিকল্প সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়তে পারে। কখনো কখনো একজনের একাধিক প্রেমিক-প্রেমিকা থাকতে পারে এবং বহুবিবাহে জড়াতে পারে।

৫. সম্পর্কে বিচ্ছেদঃ

বৈবাহিক কিংবা ভালবাসার সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে। কেননা অতিমাত্রায় অনলােইনে সময় কাটানোর মাধ্যমে নতুন সম্পর্ক তৈরি হতে পারে এবং বিদ্যমান সম্পর্কে অনিহা আসতে পারে।

৬. ইন্টারনেটকে সকল সমস্যার সমাধান মনে করাঃ

যদি কোন ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয় যে, আপনার মানসিক প্রশান্তি পেতে, অস্থিরতা দূর করতে, বিরক্তিকর অবস্থায় এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট কী যথেষ্ট? সে যদি উত্তরে হ্যা বলে, তাহলে সে ইন্টারনেটে আসক্ত।

শিশুদের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট আসক্তির লক্ষণ

১. পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজে অমনোযোগী হওয়াঃ শিশু-কিশোরদের মাত্রাতিরিক্ত কম্পিউটার বা মোবাইলের প্রতি ঝোক এবং ইন্টারনেট ছাড়া অন্যসব ক্ষেত্রে অমনোযোগী হওয়া।

২. গোপনে ইন্টারনেট ব্যবহার করার চেষ্টাঃ

শিশুদেরকে দিনে ছয় ঘন্টার বেশি অনলাইনে নিমজ্জিত থাকলে ও লুকিয়ে লুকিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেখলে বুঝতে হবে সে আসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

৩. মোবাইল বা ইন্টারনেট যখন ভাল লাগার উৎসঃ

শিশুদের দিকে খেয়াল করতে হবে, তারা দীর্ঘ সময় ইন্টারনেটে ব্যবহার করছে কিনা এবং মোবাইল-কম্পিউটার না পেলে তাদের বিষন্নতা ও বিরক্তবোধ করে কিনা। ইন্টারনেট পেলেই সে খুব আনন্দিত হচ্ছে কিনা, তা খেয়াল করতে হবে। যদি তারা এসব ছাড়া থাকতে অস্বস্তি বোধ করে, তাহলে বুঝতে পারবেন সেই শিশুটি ইন্টারনেটে আসক্ত।

৪. ঘুমের পরিমাণঃ

যেসব শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহারে মজা পেয়ে যায়, তারা যেকোন সময় ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ খোঁজবে। এছাড়া রাতে বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে না ঘুমিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকে প্রাধান্য দিবে।

৫. বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনকে এড়িয়ে চলাঃ

শিশুদের অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে বাবা-মায়ের সাথে কথা-বার্তা কমিয়ে দেয়া এবং তাদের যেকোন নির্দেশ এড়িয়ে যাওয়া। এমনকি বাবা-মাসহ আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখলে তার ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ লক্ষ্য করতে হবে। কারণ ইন্টারনেট আসক্তির ফলে শিশু ও অভিবাবকের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা।

৬. মিথ্যে বলাঃ

শিশুরা ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়লে যেকোন শর্তে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চাইবে। ইন্টারনেটে আসক্ত শিশুদের মধ্যে বাবা-মাকে মিথ্যে বলার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই কোন শিশু মোবাইল বা কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য যখন অনেক অজুহাত খোঁজে তখন বুঝতে হবে সে মিথ্যে বলছে এবং সে ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

৭. নতুন বন্ধু তৈরি ও অস্বাভাবিক আচরণঃ

শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহারের মধ্য দিয়ে অনেক নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করে ও তাদের সাথে ভার্চুয়াল সম্পর্ক গড়ে তোলে। বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গিয়ে তাদের আচরণে অনেক পরিবর্তন আসে।

৮. ক্ষিপ্ত আচরণঃ

শিশুদের চাহিদামত ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধা দিলে যখন সে রেগে যায় এবং ক্ষিপ্ত হয়ে ভাংচুর বা অন্যান্য প্রতিক্রিয়া দেখায়, তখন বুঝতে হবে সে ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে।

৯. সৃজনশীলতার ঘাটতিঃ

ইন্টারনেটে এত বেশি তথ্য রয়েছে যে মানুষকে নতুন করে আর ভাবতেই হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের ভাবনার দরজা ইন্টারনেট পর্যন্তই থেমে যাচ্ছে, তাদের নতুন করে নিজে নিজে চিন্তা করে উত্তর আবিষ্কার করতে হচ্ছে না।

কীভাবে ইন্টারনেট আসক্তি দূর করা যাবে?

ইন্টারনেট আসক্তি দূর করার ক্ষেত্রে একেকজনের জন্য একেক পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে। অনেকের ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট আসক্তির পেছনে অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, মেন্টাল স্ট্রেসের সমস্যা লুকায়িত থাকে। এমনটা হলে সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিয়ে এরপর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এছাড়া কগ্নিটিভ থেরাপি, বিহাভিয়ারাল থেরাপি, আর্ট থেরাপি, ফ্যামিলি থেরাপি, স্কিল-বিল্ডিং ট্রেইনিংসহ বিভিন্ন কার্যকর পদ্ধতির মাধ্যমে এই আসক্তি থেকে একজনকে বের আনা সম্ভব।

ইন্টারনেট আসক্তি দূর করার কার্যকর উপায়
ইন্টারনেট আসক্তি দুর করতে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করুন -

১. ইন্টারনেট ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণ করুন

ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করুন। আপনি দিনে কতক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন, কেন ব্যবহার করবেন, কী কী কাজ ব্যবহার করবেন? এসব কিছু আগে নির্ধারণ করুন। তারপর কাজে নেমে পড়ুন। পরিকল্পনা করার পর কোনোক্রমেই পরিকল্পিত সীমারেখা অতিক্রম করবেন না। তাহলে খুব দ্রুতই আপনার ইন্টারনেট আসক্তির মাত্রা কমে আসবে।

২. পরিবার এবং বন্ধুদের কাছে টেনে নিন

ইন্টারনেট আসক্তি নিশ্চয়ই আপনাকে পরিবার এবং বন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে? সুতরাং ইন্টারনেট আসক্তি কমাতে ইন্টারনেটকে দূরে ঠেলে পরিবার ও বন্ধুকে কাছে টেনে নিন। দৈনন্দিন ইন্টারনেট ব্যবহারের নির্ধারিত সময়সীমা পার করার পর সম্পূর্ণভাবে পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবকে সময় দিন। এরপর থেকে আর কখনোই ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে পরিবারের সাথে মিথ্যাচার করবেন না। মনে রাখবেন এই মিথ্যাচার নিজের সাথে প্রবঞ্চনার শামিল।

৩. অন্যদের কম্পিউটার ব্যবহারের অনুমতি দিন

আপনি নিশ্চয়ই এতদিন নিজের কম্পিউটার কাউকে ব্যবহার করতে দেননি! কম্পিউটারের সকল পাসওয়ার্ড গোপন রেখেছেন। এবার নিজের ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে অন্যদের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ দিন, একবার অন্যের হাতে কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ দিলে আপনি চাইলেই ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে পারবেন না, যা ধীরে ধীরে আপনার ইন্টারনেট আসক্তির মাত্রা কমিয়ে আনবে।

৪. আপনার রুটিন পরিবর্তন করুন

ইন্টারনেট আসক্তি কমিয়ে আনার আরেকটি মোক্ষম উপায় হলো দৈনন্দিন রুটিন পরিবর্তন করা। আপনার যদি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ইমেইল চেক করার অভ্যাস থাকে, বা কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরেই ইন্টারনেটে বসার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন, তবে শুরুতে এটি পরিবর্তন করার চেষ্টা করুন। ইমেইল চেক করে নয়, আপনার প্রতিটি সকাল শুরু হোক অন্য কিছু দিয়ে। দিনের শুরুতেই কম্পিউটারের কাছে না গেলে এটি ব্যবহারের আসক্তি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। প্রতিদিন সকালের প্রয়োজনীয় কাজ করুন। নিজের পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিন। এরপর ইন্টারনেট ব্যবহারের কিছুটা সময় বের করুন। এক কথয় ইন্টারনেটের চেয়ে বাস্তব জীবনের মানুষগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিন।

৫. বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে কম্পিউটার ব্যবহার বন্ধ করুন

যেহেতু আপনি ইন্টারনেট আসক্ত তাই এই আসক্তি দূর করতে আপনাকে বিশেষ কিছু করতে হবে। ব্যবসায়িক বা পেশাদারী কাজের বাইরে বিনোদনমূলক কোনো কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। কম্পিউটার ব্যবহার করে বিনোদিত হওয়ার ছেলেমানুষী আবেগ পরিহার করার চেষ্টা করুন। অন্তত কয়েক মাসের জন্য কম্পিউটার গেম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার থেকে দূরে থাকুন। ইন্টারনেটের অলিগলিতে খোঁজ করা বিনোদন বাস্তব জীবনে খুঁজে নিন। সম্পূর্ণভাবে ইন্টারনেট জগত থেকে বের হয়ে রক্ত মাংসের মানুষের সাথে বাস্তব জীবনের আনন্দ উপভোগ করুন।

৬. বেড়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন

পরিবারের সবাই মিলে কিংবা বন্ধুরা একসাথে দর্শনীয় কোন স্থানে ঘুরে আসতে পারেন। ভ্রমণ আপনার মনকে আনন্দময় ও প্রফুল্ল করে তুলবে।

৭. নিয়মিত খেলাধুরা ও ব্যায়াম করুন 

নিয়মিত খেলাধুলার ব্যায়ামের  অভ্যাস গড়ে তুলুন। দৈনিক অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন। 

৮. প্রতিদিন বই পড়ুন

একাধিক কেস স্টাডিতে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে বই পড়ার সময় মন খুব শান্ত হয়ে যায়, যেমনটা প্রাণায়ম করার সময় হয়ে থাকে। ফলে মানসিক চাপ কমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক প্রভৃতি মারণ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও হ্রাস পায়। তাই প্রতিদিন বই পড়ার অভ্যাস করুন।

৯ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করুন

বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সাথে নিজে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করুন। ধর্ম পালনে অভ্যাস গড়ে তুলুন।

১০. অগ্রগতি পরিমাপ করুন 

ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে প্রচেষ্টা শুরু করার পর থেকে ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন আপনি ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে চেষ্টা করছেন। ধাপে ধাপে নিজের অনলাইনে ব্যবহৃত সময়ের চেয়ে বাস্তব জীবনে ব্যবহৃত সময়ের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলুন। তুলনামূলকভাবে অনলাইনে পূর্বের তুলনায় কতটা সময় দিচ্ছেন তা পর্যালোচনা করুন। চেষ্টা করুন সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ ঘন্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে এবং পর্যায়ক্রমে আরো কমিয়ে আনতে।

আপাতদৃষ্টিতে বিচার করলে, এই পরামর্শগুলো পড়ে আপনার মনে হতে পারে আমি আপনাকে কর্মহীন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। না, মোটেও তা নয়। আপনি যদি ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে এখনই প্রচেষ্টা শুরু না করেন তবে অদূর ভবিষ্যতে জীবনে অনেক বড় বিপর্যয় নেমে আসবে, যা আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে, ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে অসুখী করে তুলবে। সুতরাং আসক্তি দূর করতেই হবে। আর এই কাজে শুরুতে আপনাকে একটু বেশি ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।


Post a Comment

1 Comments